ভালবাসার সাতকাহন (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-১১)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৩ অক্টোবর, ২০১৪, ০২:৩০:০৯ দুপুর
দশ বছর হলো বাবা মা'কে ছেড়ে এসেছে রায়হান।
দশ বছর!
সে -ই কি ছেড়ে এসেছে? ছাড়াছাড়িটা আসলে কিভাবে যেন হয়েই গিয়েছিল। বাঁধনটা কেন যেন শ্বাসরোধ করে ফেলছিল সবার। নিরূপায় হলে হয়ত কোনভাবে জোড়াতালি দিয়ে একটা জীবন চলে যেত।
হয়ত রায়হানই ছেড়ে এসেছে।
একটা পরিবারের কর্তা হিসাবে সে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেছে ভাংচুর করে! বাবা মা'কে , রুমাকে সত্যি সত্যি বোঝার মত, বোঝাবার মত জ্ঞান যদি তার থাকতো!
জ্ঞানটুকু হবার জন্য এই দশটা বছর তার দরকার ছিলো! কত কম জেনে সে সংসার শুরু করেছিল!
সেই পরিবারের কর্তা- বাবার সেদিন কেমন লেগেছিল?
রায়হানের বিয়ের পরে বাবা এল.পি.আর এ যান এবং রায়হানকে ও নিয়ে যেতে চান বরগুনা জেলা শহরে, সেখানে তার শহরে বাড়ি আছে- ওখানেই থাকার ইচ্ছেটা পোষণ করেন। সেখানের একটি বেসরকারী কলেজে রায়হান এবং রুমার জন্য প্রভাষকের জব ও ঠিক করে ফেলেছিলেন।
কিন্তু রায়হান এবং রুমা চট্টগ্রামের মত বড় শহরে বেড়ে উঠায় ঐ মফঃস্বল শহরে থাকতে চাইলো না।
বিরোধ প্রথম স্পষ্ট হয়েছিল সম্ভবত বিয়ের ক'দিন পরে রায়হানের বাবা রুমাকে পর্দায় থাকার জন্য বলাতে ।
রুমা বিরক্ত হল।
'আমিতো ভদ্রভাবেই চলি! '
রায়হান দেখল সত্যিই সে অশালীন চলে না। অন্য অনেক মেয়ের চেয়ে বরং ভালো। তাহলে কি রুমাকে নিজের মেয়ে ভাবতে পারছেন না? নিজের ছেলেদেরকে তো এভাবে কখনো জোর করেননি। করলে তারা কি অন্য রকম হতো না?
বাবা ধর্ম যতটা মানেন, রুমা এখনো ততটা মানে না। সে তো আর ধর্ম অস্বীকার করে না। জোর করা কেন? ধর্ম যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তার জামা কাপড় কারো ক্ষতি করছে না।
রায়হান ও রুমাকে সমর্থন করল।
'বাবা আমি ওর মধ্যে তো খারাপ কিছু দেখছি না।'
নিজের বউয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কি সে নিজে নিতে চাইছিল?
স্বামীর সমর্থনে সহজ বোধ করেই কিনা কে জানে, রুমা বলল, ' সারা জীবন এভাবেই চলেছি'
রায়হানের বাবার কপালে ভাজ পড়ল, 'এখন তুমি আমাদের বউ, তোমার শাশুড়ি এবং এই পরিবারের অন্যরা যেভাবে চলে, তুমিও সেভাবে চলবে।'
রুমা গম্ভীর হল, ' বিয়ের আগে আমি কিভাবে চলেছি সেটা দেখেই আপনারা আমাকে পছন্দ করেছেন, এখন কেন আমার উপর আপনাদের ইচ্ছেটা চাপিয়ে দিচ্ছেন?
এরপর খিটিরমিটির চলতেই থাকল।
শেষ পর্যন্ত একটা তুচ্ছ কথায় একদিন খাবার টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত হয়েই গেল।
নাশতার টেবিলে কাজের মেয়েটা ময়লা একটা প্লেট দিয়ে গিয়েছিল। রুমা একটু জোরেই বলে ফেলল, ' যা ইচ্ছা তাই করে! কি করল দেখেও না।' রায়হানের শান্ত মা 'টা হঠাৎ কেন বললেন,' শিক্ষিত লোকেরাই যা ইচ্ছা করে, মুর্খ লোকে করবে না?'
আগের সন্ধ্যায় কথায় কথায় শাশুড়িকে বলা রুমার বেফাঁস কথাটা উপস্থিত চারজনেরই কানে বেজে উঠল। 'এতো পড়ালেখা করে শেষে গ্রামে গিয়ে পড়ে থাকব?'
এখন সেই কথার রেফারেন্সে, আর হয়ত সচেতনভাবে ঝগড়া করার জন্য নয়, তবু বেশ কিছুদিনের নানান বিরোধ ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকায় বোধ হয় ধৈর্যটা আর ধরে রাখতে পারল না রুমা। ওর মুখ লাল হয়ে গেল। ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল,' কি করে শিক্ষিত লোকেরা? '
মা প্রথমে অপ্রস্তুত হয়ে শেষে বলে ফেললেন,' যে যা করে সে তা জানে। '
বাবার খাওয়া ধীর হয়ে গিয়েছিল। সেদিন বাবা খাওয়াটা বোধ হয় শেষ করতেও পারেন নি। এতবছর পরও সে বাবার সেই সকালের খাবারটা খেতে না পারার জন্য মনে মনে মা আর রুমাকে দোষ না দিয়ে পারল না।
'কেউ একজন চুপ করে থাকতে পারত না?'
অবশ্য সে নিজে যদি ম্যানেজ করতে পারত তাহলেও এমন হত না।
বাবা কিছুক্ষণ লড়াইটার মাঝখানে বসে রইলেন। এক সময় চাপা গলায় বললেন , ' অসম্ভব!'
কর্তা পুরুষ নিজের অজান্তে ঘোষনা দিয়ে ফেললেন। বিদ্রোহ সইবেন না।
কেউ জিজ্ঞেস করল না কি অসম্ভব। সবাই বুঝতে পারছিল, একসাথে থাকা অসম্ভব।
মা আসলেই রুমার জেদ সইতে পারছিলেন না। প্রতিদিনের বিরোধের সাক্ষী হওয়া বাবা আর রায়হানের জন্যও কঠিন ছিল। আড়ালে আরো কত সত্য ছিল কে জানে।
রায়হান অতটুকু শুনেই বলল, ' তাহলে আমরা আপনার সাথে না যাই ।'
অবচেতনে রায়হান কি নিজের একটা রাজত্ব চাইছিল? বাবা কি তা বুঝলেন? কেন বললেন না, ' ঘরটা ভেংগো না।'
তার কত মমতায়, কতদিনের শ্রমে গড়া সংসার। তিনি কি পরিত্যাক্ত বোধ করে কষ্ট পেয়েছিলেন? রায়হান রুমাকে কি অকৃতজ্ঞ ভাবছিলেন?
বাবা বললেন, 'হ্যা, এখন বড় হয়েছ, বুঝতে শিখেছ, নিজের ভালো মন্দ বুঝবার মত বয়স হয়েছে। যা খুশী করতে পার। তবে আমার দরজা তোমার জন্য ... তোমাদের জন্য সব সময় খোলা রইলো।"
সেদিনই রুমাকে নিয়ে রায়হান ওর মামার বাসায় চলে যায়। সেই মুহূর্তে আর কিছু কী হতে পারত?
মামা সব শুনে রাশেদুল করীমের উপর রাগ করলেন। ওদের ইমোশনকে আশ্রয় দিলেন। তারা আশ্রয় পেয়েছিল মামার কাছে। বাবা মায়ের আবেগের খবর কি কেউ নিয়েছিল?
মামা ওদের বিয়েতে যে সব ফার্ণিচার দিয়েছিলেন সেগুলো সহ সেদিনই রুমা রায়হানের বাবার বাসা থেকে চলে এসেছিল।
সেই থেকে রায়হান ওর বাবার সাথে রাগ করে দূরে মামা শ্বশুরের আশ্রয়ে ছিল। এর মাঝে সে কিছুদিন জব করেছে, ছেড়েছে, আবার বসে থেকেছে। সর্বশেষ জব করত রামপুরায় থাকাকালীন।
সেটা ছাড়ার পর এই শমশেরনগরে এসেছে।
আজ এতোদিন পরে রুমার পাশে দাঁড়িয়ে মিতুকে দোল দিতে দিতে এসব কথাই রায়হান ভাবতে থাকে। সেদিনের সেই একটু খানি ভুল এবং নিজে বাবার পাশে থেকে মা এবং রুমার ভিতরের দ্বন্দ্ব কে যদি মিটিয়ে দিতে আরো একটুখানি শক্ত হতে পারত সে... যদি রুমার প্রতি ওর পক্ষপাত মূলক সম্মতিটুকু না দেখাত, তবে আজ হয়তো ওর নিজের একটি সম্পুর্ণ পরিবার থাকত। সেখানে বাবা, মা, ভাই এবং অন্যরা – সবাই মিলে একটি একক পরিবার হতো। এখনকার মত ক্ষুদ্র ইউনিটে বিভক্ত পরিবার নয়।
ঐ ঘটনার পর থেকে বাবাও কেন জানি আস্তে আস্তে দূরে সরে গেলেন।
মিতু জন্ম নেবার পরেও দেখতে এলেন না। মা প্রথমদিকে মোবাইলে কথা বলতেন। কিন্তু মিতুর জন্ম হবার পরেও ওনারা দেখতে না আসায়, রাগ করেই রায়হান ফোনে কথা বলাটাও বাদ দিয়ে দিয়েছে। এখন আর সে কারো ফোন রিসিভ করে না। বলতে গেলে রুমা এবং রুমার মামার নাম্বার ছাড়া রায়হানের মোবাইলে আর কারো নাম্বার সেভ করা নাই। আর অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলে রায়হান রিসিভ করে না।
পিঠাপিঠি ছোট ভাই শাহেদ ওদের এই দূরত্ব ঘোচানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু রায়হানের জেদের কাছে সেই চেষ্টা সফল হয় নাই। রায়হান ওর বাবার থেকে চলে আসার দুই মাসের ভিতরেই রাশেদুল করীম সাহেব ছোট ছেলে শাহেদের বিয়ে দিয়েছিলেন। এই ছেলে বউকে নিয়েই তিনি চট্টগ্রামের পাঠ চুকিয়েছিলেন। মফঃস্বল শহরের নিজের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন। একটা জেদের বশেই তিনি শাহেদের বিয়েটা খুব দ্রুত দিয়েছিলেন।
জেদ।
হ্যা জেদই... ভাবে রায়হান।
বাবার কাছ থেকেই তো সেও এই জেদ পেয়েছে।
একই প্রকৃতির দুইজন মানুষ যদি জেদ ধরে বসে থাকে, তবে তাদের ভিতরে মিল হয় কিভাবে?
একজনকে তো নমনীয় হতেই হয়। এখন এতোগুলো বছর পরে রায়হানের পক্ষে কি সম্ভব নিজের জনকের সামনে গিয়ে ভুল স্বীকার করা? এই দশটি বছর ওর আর রুমার কথা শুনেই তো রুমার মামা ওদেরকে এভাবে আলাদা রেখেছেন। তার কাছেও তো একেবারে প্রথম দিনটিতে ওরা দুজন পুরো সত্যটি বলে নাই। ওদের কাছ থেকে আধা সত্যটুকু জেনেই তো মুরাদ সাহেব সেদিন এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ধীরে ধীরে রায়হানের বাবা ওদের থেকে যত দূরে সরে যেতে থাকেন, মুরাদ সাহেবও ততো কাছে এসে ওদেরকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু রায়হানের নিজের জন্য আজ সে একটা ভালো অবস্থানে পৌঁছুতে পারে নাই। এরকম মানসিক অবস্থায় একজন মানুষ-ই বা কিভাবে নিজের গতীশীল জীবনে তাল মিলিয়ে চলতে পারে? পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন... অপরের দয়ায় প্রতিপালিত হয়ে... নিজের অর্ধাঙ্গিনীর কাছ থেকেও ‘কিছু করতে না পারার’ অপবাদ শুনে শুনে অস্থির সময়গুলো রায়হানকেও কি একদন্ড শান্তি দিয়েছে?
তাই সে কিছুই হতে পারেনি... নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি।
এখন যদি এই অবস্থায় ওর বাবার কাছে ফিরে যায়, তিনিও কি ভাববেন না যে, বড় হতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে রিক্ত হাতে সে ফিরে এসেছে? রুমার মামা ও কি কষ্ট পাবেন না। তার ভিতরেও তো এক ধরণের জেদ চেপে রয়েছে। যা রুমা এবং রায়হানই অর্ধ-সত্য কথা বলাতে তৈরী হয়েছিল।
এখন আর কিছুই হবার নেই।
একধরণের হতাশা রায়হানকে ঘিরে ধরে। সে দোলনাকে জোরে আঁকড়ে ধরে এর থেকে পরিত্রাণ পেতে চায়। মিতু হঠাৎ দোলনার দোল থেমে যাওয়াতে পিছু ফিরে দেখে। রুমাও তাকায়। কিন্তু এই দুজন যাকে দেখছে সে এই মুহুর্তে কেমন যেন অস্থির এবং দিশেহারা। রুমা রায়হানের হাত ধরতেই সে বাস্তবে ফিরে আসে।
হাসে।
রুমার হাতে ফিরতি স্পর্শের অনুভূতি জাগিয়ে বোঝায় সে ঠিক আছে।
কিন্তু আসলেই কি সে ঠিক আছে?
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৯৭৯ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো তাই পিলাচ ও অনেক ধন্যবাদ।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনার প্রতি রইলো শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
বেশ কিছুদিন যাবৎ ব্লগে নিয়মিত হতে পারিনি, তাই আপনি সহ অনের গুরুত্বপূর্ন ব্লগারদের সেরা লিখা গুলো দেখার সুযোগ পাইনি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
ধীরে ধীরে সময় করে পড়ে নিবেন।
সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা রইলো নিরন্তর।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগতম।
এর আগের ১০ টি পর্ব সময় করে পড়ে নিয়েন।
আপনার অপেক্ষার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
অনুভূতি রেখে যাবার জন্যও অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ধর্ম জোর করে পালন করানো যায় না,স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই পালন করতে হয়। অর্ধাংগিনী-যাকে নিয়ে ইহ জগত পাড়ি দেয়ার পর পরকালীন জীবনেও পাওয়ার আকাঙখা,তাকে ধর্মীয় বিধান পর্দা-নামাজ ইত্যকার বিষয়ে বলা অবশ্য ই উচিত!
'রায়হান' সাহেব তো অনেক ভাগ্যবান যে,অন্ততঃ 'রুমা'আছে তার! কিছু কিছু মানুষদের তো তাও থাকে না।
রুমারা রায়হান সাহেবদের আশেপাশেই রয়েছে। কেবল সঠিক রুমাদেরকে খুজে পাবার অ্পেক্ষা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
'সঠিক রুমা'দের খুজে পাওয়া এতো সহজ নয়..........!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন